আর্থিক প্রতিষ্ঠানে 25% ডিফল্ট হার
আর্থিক প্রতিষ্ঠানে 25% ডিফল্ট হার
দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি এখনও বিতর্কিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের অনিয়ম থেকে বিপর্যস্ত। তার মালিকানাধীন চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার অত্যন্ত বেশি। এছাড়া তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের সার্বিক চিত্রে এর প্রতিফলন ঘটেছে। ফলে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টিতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর মধ্যে ১৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৩০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। এদের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮০ থেকে ৯৯ দশমিক ৬২ শতাংশ পর্যন্ত। তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ অপরিবর্তিত ছিল, ছয়ে নেমে এসেছে।
যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অ-পারফর্মিং লোন 80 শতাংশের বেশি সেগুলি হল পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড এবং ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। . প্রথম চারটি কোম্পানির মালিক পিকে হালদার। আবার এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অধিকাংশ টাকা বেনামে তুলে নিয়েছেন, যা এখন খেলাপি হয়ে গেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোরালো ভূমিকা থাকা দরকার। যারা এসব প্রতিষ্ঠানের এ অবস্থা করেছে তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। পিকে হালদার কে তা সবাই জানে। এ জন্য আমানতকারীদের টাকা জমা দেওয়ার জন্য ভালো প্রতিষ্ঠানের খোঁজ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের অবস্থা ছিল ৭১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৭০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে ৮২৯ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে 17,855 কোটি টাকা হয়েছে, যা ডিসেম্বরে 16,821 কোটি টাকা ছিল। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬২২ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি-মার্চ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এমন ২৬টি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স। তিন মাসে কোম্পানিটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬০ কোটি টাকা। এরপর ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া আইডিএলসি ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০৪ কোটি টাকা, আইডিকল ৯৪ কোটি টাকা, বে লিজিং ৯৩ কোটি টাকা, বিআইএফএফএল ৭১ কোটি টাকা, লংকাবাংলা ৬৭ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ৫২ কোটি টাকা, আইপিডিসি ফাইন্যান্স ৪৩ কোটি টাকা, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ৪৩ কোটি টাকা। 37 কোটি টাকা, মাইডাস ফাইন্যান্স থেকে 30 কোটি, আইআইডিএফসি থেকে 29 কোটি, পিপলস লিজিং থেকে 25 কোটি এবং মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স থেকে 25 কোটি টাকা। তালিকায় রয়েছে অগ্রণী এসএমই, আভিভা ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, সিভিসি ফাইন্যান্স, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং, জিএসপি ফাইন্যান্স, ইসলামিক ফাইন্যান্স, লঙ্কান অ্যালায়েন্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্স।
চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে এফএএস ফাইন্যান্স, ৯১ কোটি টাকা। এ ছাড়া উত্তরা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ কমেছে ৮৯ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৪৭ কোটি টাকা, হজ ফাইন্যান্সের ১৯ কোটি টাকা, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ৪ কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ১ কোটি টাকা।
তবে এ সময়ে তিন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণে কোনো পরিবর্তন হয়নি, সেগুলো হলো সৌদি-বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড এগ্রিকালচার ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি, স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স এবং ইউএই-বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানে 25% ডিফল্ট হার
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান এবং আইআইডিএফসি-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া প্রথম আলো</em>কে বলেন, কোভিডের কারণে যে ঋণ খেলাপি হয়নি তা এখন খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তবে ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কমবে।
গোলাম সারোয়ার ভূঁইয়া বলেন, নিজেরা ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারার কারণে নিয়মিত ঋণ রাখা ঠিক নয় বলে মনে করি। ঋণের প্রকৃত অবস্থা দেখাতে হবে। গোপন রাখলে একদিন আসল চিত্র বেরিয়ে আসবে। বরং ঋণ খারাপ হলে এবং তা আদায় না হলে আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়াই ভালো।
গত ২৭ আগস্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠকে জানানো হয়, দেশের ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টিরই ৩২ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে।
এ অবস্থায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।